মুগডাল ভাঙানো মিনি-মিল : উপকূলের কৃষকদের জন্য একটি আশীর্বাদ
ড. এম জি নিয়োগী
বাংলাদেশের মোট উৎপাদিত মুগডালের তিন ভাগের দুই ভাগই দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকা বৃহত্তর বরিশাল থেকে আসে। বিশেষ করে পটুয়াখালী-বরগুনা অঞ্চলেই প্রতি বছর ১ লক্ষ ৫০ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমিতে প্রায় ২ লক্ষ টন মুগডাল উৎপাদন হয়, যা বাংলাদেশের মোট উৎপাদিত মুগডালের অর্ধেকেরও বেশি।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এখানকার কৃষকরা মুগডাল চাষাবাদে আগ্রহী হচ্ছেন; কারণ উপকূল অঞ্চলে ৪ লক্ষ হেক্টরেরও বেশি জমি শুষ্ক মৌসুমে পতিত থাকছে। এই অঞ্চলের বেশির ভাগ কৃষকরা বছরে একটি মাত্র ফসল আমন ধান আবাদ করতে পারেন, যা ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে কৃষকরা সাধারনত: কেটে থাকেন। ধান কাটার পরে শুষ্ক মৌসুমে জমিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া বেশকিছু জায়গায় জলাবদ্ধতা এবং এই এলাকার সেচযোগ্য পানির দুষ্প্রাপ্যতার কারণে কৃষক বছরের বাকি সময় আর তেমন কোন ফসল আবাদ করতে পারেন না।
ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে ধান কাটার সময় জমিতে সাধারণত লবণাক্ততা কম থাকে। ফেব্রুয়ারি মাসেও লবণাক্ততা সহনীয় পর্যায়ে থাকে। মার্চ মাসে লবণাক্ততা বাড়তে থাকে এবং এপ্রিল-মে মাসে খুবই বেড়ে যায়। মুগডাল অত্যন্ত কম সময়ের ফসল, মাত্র ৭০-৭৫ দিনে এই ফসল ঘরে তোলা যায়, অর্থাৎ এরচেয়ে কম সময়ে আর কোন ফসল ঘরে তোলা যায় না। মূলত ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে আমন ধান কাটার পর যখন কোন প্রকার শীতকালীন বা দানাজাতীয় কোন ফসল চাষাবাদের সময় থাকে না, তখন একমাত্র মুগডাল ফসল জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে জমিতে বপন করা যায়।
সেই জন্য ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে ধান কাটার ঠিক পরেই পতিত জমিতে চাষ দিয়ে জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে জমিতে জোঁ অবস্থায় যদি মুগডালের বীজ বোনা যায়, তাহলে বীজ বোনার ৭০-৭৫ দিনের মধ্যেই অর্থাৎ মার্চের শেষে বা এপ্রিল মাসের প্রথমেই অর্থাৎ জমিতে লবণাক্ততা বাড়ার আগেই প্রথমবারের ফসল ঘরে তোলা সম্ভ¢ব।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এখন আগাম বৃষ্টি হচ্ছে। এপ্রিল-মে মাসে বৃষ্টি হলে লবণাক্ততার তীব্রতা হ্রাস পায়। তখন দ্বিতীয়বার এমনকি তৃতীয়বারও মুগ ফসল ঘরে তোলা সম্ভ¢ব। হালকা বৃষ্টি হলে মুগ ফসলের জন্য ভাল। তবে বেশি বৃষ্টি হলে অথবা বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকলে জমিতে মুগ ফসল নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়াও মুগ গাছের শিকড়ে নডিউল তৈরি হয়, যা মাটিকে উর্বর করে। মুগ ফসল তোলার পর পুরো গাছ জমিতে মিশিয়ে দিলে জমির উর্বরতাও বাড়ে। এতে জমির লবণাক্ততাও কিছুটা কমে যায়।
বরিশাল অঞ্চলের কৃষকরা প্রচুর মুগডাল চাষাবাদ করছেন। কিন্তু তারা কাক্সিক্ষত বাজারমূল্য পাচ্ছেন না। বাজারে এক কেজি মুগডালের মূল্য ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা, কিন্তু কৃষক তাদের উৎপাদিত মুগ কালাই (খোসাসহ) মাত্র ৫০-৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। মূল সমস্যা হচ্ছে, মুগডাল উৎপাদিত এলাকায় মুগকালাই ভাঙানো মেশিন না থাকার কারণে কৃষক তার উৎপাদিত মুগকালাই অর্ধেকেরও কম মূল্যে বিক্রি করে দিচ্ছেন।
যেহেতু কৃষকরা ১৪০-১৬০ টাকার মুগডাল মাত্র ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন, সেজন্য তারা মুগ কালাইয়ের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সাধারনত: প্রতিটি গ্রামেই ধান, গম, মরিচ, হলুদ, সরিষা ইত্যাদি ভাঙানোর মেশিন আছে। কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য খুব সহজেই গ্রামের এই সমস্ত মেশিন থেকে ভাঙিয়ে নিয়ে খেতে পারেন এবং বাজারে অধিক মূল্যে বিক্রি করতে পারেন। কিন্তু গ্রামের এই সমস্ত মিলে মুগকালাই ভাঙানোর কোন মেশিন না থাকার কারনে কৃষক বাধ্য হয়েই অত্যন্ত কম মূল্যে ফড়িয়াদের কাছে বা স্থানীয় বাজারে তাদের উৎপাদিত মুগ কালাই বিক্রি করে দেন। এমনকি অত্যন্ত সুস্বাদু পুষ্টি সমৃদ্ধ এই মুগডাল কৃষক পরিবারের সদস্যরা খেতেও পারেন না। মুগ ডাল খেতে হলে বাড়িতে যাঁতা বা শিল-পাটায় মুগকালাই ভাঙিয়ে নিয়ে তা কূলাতে পরিষ্কার করে তারপরে রান্না করতে হয়- যা অত্যন্ত কষ্টকর এবং সময় সাপেক্ষ। সেজন্য কৃষকদের ঘরে মুগকালাই থাকলেও এমনকি মুগডাল তাদের পছন্দনীয় খাবার হওয়া সত্ত্বেও তারা সপ্তাহে এক দিন বা মাসে মাত্র ২-৩ দিন মুগডাল খেয়ে থাকেন।
এছাড়া বাজারে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রং এবং কেমিক্যালযুক্ত গাঢ় হলুদ রংয়ের মুগডাল বিক্রি হচ্ছে, যা মানব শরিরের জন্য ক্ষতিকর। পরিষ্কার পানিতে রং এবং কেমিক্যালযুক্ত গাঢ় হলুদ রংয়ের এই মুগডাল ভিজিয়ে রাখলে সমস্ত পানি কিছুক্ষণের মধ্যেই হলুদ বর্ণ ধারণ করবে। সাধারণ মানুষ বাজারের এই সমস্ত মুগডাল কিনে প্রতারিত হচ্ছেন।
সে সাথে মুগডাল চাষাবাদকে কৃষকের কাছে আরও গ্রহণযোগ্য এবং জনপ্রিয় করার জন্য অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশের এই যৌথ প্রকল্প (ঈওগ-২০১৪-০৭৬) বিশেষ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে, যাতে করে কৃষকরা মুগডাল উৎপাদন করে কাক্সিক্ষত বাজারমূল্যে পায় এবং পরিবারের সদস্যরা পুষ্টিসমৃদ্ধ এই মুগডাল যেন নিয়মিত খেতে পারে।
অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশের এই যৌথ প্রকল্প দীর্ঘ ৫ বছর ধরে ড. এম জি নিয়োগীর তত্ত্বাবধানে মুগকালাই ভাঙানোর জন্য মিনি-মিল নিয়ে গবেষণা করেছেন। মিনি-মিল একটি ছোট আকারের ডাল ভাঙানোর মেশিন, যা স্থানীয় কারিগর দ্বারা তৈরি। এর খুচরা যন্ত্রাংশ স্থানীয় বাজারে সহজলভ্য। গ্রামে গ্রামে ধান ভাঙানো, গম ভাঙানো, হলুদ-মরিচ ভাঙানো মেশিন আছে। এ সমস্ত মেশিন স্থানীয় মিস্ত্রিরাই তৈরি করে থাকেন। কিছু কিছু এলাকায় ছোট ছোট ডাল ভাঙানো মেশিনও আছে।
ইতোপূর্বে অঈওঅজ-গঁৎফড়পয টহরাবৎংরঃু ডাল ভাঙানোর মেশিন নিয়ে কাজ করেছিল। মূলত এখান থেকেই ডাল ভাঙানোর মেশিনের বিষয়ে আমাদের ধারণা হয় এবং ঈওগ-২০১৪-০৭৬ প্রকল্পের তথ্য উপাত্তেও প্রতীয়মান হয় যে, গ্রামে গ্রামে মুগডাল ভাঙানো মেশিন থাকলে, কৃষক তাদের উৎপাদিত মুগডাল সহজেই ভাঙাতে পারবে- ভালো মূল্যে বাজারে বিক্রি করতে পারবে এবং প্রতিদিন তারা মুগডাল খেতে পারবে, যা পরিবারের সদস্যদের পুষ্টির চাহিদা মিটাবে।
এই মিনি-মিল দিয়ে এখন অনায়াসে মুগকালাই ভাঙানো যাচ্ছে। বিশেষ ধরনের রোলার এই মিনি-মিলে বসানো হয়েছে। এতে মুগকালাইয়ের খোসা ছাড়ানো ত্বরান্বিত হয়। মুগকালাইয়ের খোসা সহজে ছাড়ানোর জন্য মুগকালাইকে ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। দেখা গেছে, ৫ কেজি মুগকালাইয়ে ৩০ গ্রাম পরিমাণ সয়াবিন বা সরিষার তেল মাখিয়ে ভাল করে রোদে শুকিয়ে নিলে এই মেশিনে খুব সহজেই মুগকালাই ভাঙানো যায়। এই মিনি-মিলে শুধু মুগকালাই নয় - মসুর, খেসারিসহ অন্যান্য ডালও ভালভাবে ভাঙানো যায়।
মিনি-মিল ১৫ হর্স পাওয়ারের ডিজেল ইঞ্জিন বা ইলেকট্রিক মোটর দ্বারা চালিত। এটি কাঠের তৈরি প্লাটফর্ম, রোলার, পাওয়ার ট্রান্সমিশন পুলি, স্টার্টার, কাটআউট, ফিডিং চেম্বার, সিভ, ট্রে, সেফটি কভার, কেসিট, বেল্ট, তার, লোহার রড এবং বল বিয়ারিং দ্বারা সংযুক্ত। এ পর্যন্ত বরিশাল, পটুয়াখালী এবং বরগুনা জেলার মুগডাল উৎপাদিত এলাকায় গ্রামে গ্রামে চলমান ধান ভাঙানো মিলে পরীক্ষামূলকভাবে ১০টি মুগডাল ভাঙানো মিনি-মিল বসানো হয়েছে। অভাবনীয় ফলাফলের প্রেক্ষিতে, ২০২২ এর জুন-জুলাই মাসে আরো ২০টি মিনি-মিল বসানোর কাজ হচ্ছে, যার খুচরা যন্ত্রাংশ স্থানীয় বাজারে সহজলভ্য এবং স্থানীয় কারিগররাই প্রয়োজনে এই মিনি-মিলগুলো মেরামত করতে পারবে।
যে ১০টি গ্রামে এ সমস্ত মুগডাল ভাঙানো মিনি-মিল বসানো হয়েছে, সেখানকার মুগডাল কৃষকরা আজ ব্যাপকভাবে মুগডাল চাষাবাদে উৎসাহিত এবং অনুপ্রাণিত। তারা তাদের উৎপাদিত মুগডাল এই মিনি-মিলে মানসম্মতভাবে ভাঙাতে পারছে। বাজারে তা দ্বিগুণের বেশি মূল্যে বিক্রি করে আর্থিক দিক দিয়ে লাভবান হচ্ছে। এখন তাদের পরিবার প্রায় প্রতিদিনই এই পুষ্টি সমৃদ্ধ মুগডাল খেতে পারছে। আমাদের বিশ^াস, শুধুমাত্র মুগডাল ভাঙানো মিনি-মিলের কারণেই এই অঞ্চলের কৃষকরা মুগডাল চাষাবাদে যত্নবান হচ্ছেন। এতে প্রায় দ্বিগুন ফলন নিশ্চিত হচ্ছে। এই মিনি-মিল উপকূল অঞ্চলে মুগডাল সম্প্রসারণে ব্যাপক অবদান রাখছে।
এ ধরণের মিনি-মিল প্রতিদিন এক থেকে দুই হাজার কেজি পর্যন্ত ডাল ভাঙাতে পারে। ডাল ভাঙানোর পাশাপাশি গবাদি পশুকে খাওয়ানোর জন্য কৃষক ভূষি পাচ্ছে
আমরা আশা করি সরকার মিনি-মিল প্রযুক্তির উপযোগিতা অনুধাবন করে উপকূলের গ্রামে গ্রামে মুগডাল ভাঙানো মিনি-মিল বসানোর উদ্যোগ নিবে এবং উপকূলের পতিত জমিতে মুগডাল উৎপাদন ও বিস্তারে ভূমিকা রাখবে। অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশের ৫০ বছরের বন্ধুত্বের এটিই হোক উপকূলের কৃষকদের জন্য সবচেয়ে বড় টেকসই উপহার।
লেখক : ডেপুটি প্রজেক্ট লিডার, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া। মোবাইল: ০১৭১২-০৪৯৭৪২, ইমেইল : mgneogi@gmail.com